বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্গত পশ্চিম ও দক্ষিণে মেঘনা নদী বিধৌত উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর । সীমানার উত্তরে চাঁদপুর জেলা, পূর্বে নোয়াখালী জেলা, দক্ষিণে নোয়াখালী ও ভোলা জেলা এবং পশ্চিমে ভোলা ও বরিশাল জেলা । লক্ষ্মীপুর জেলা ২২০৩০'হতে ২৩০১০' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯০০৩৮' হতে ৯০০০১' পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। জেলার নামকরণের পেছনেও রয়েছে নানা মত। কেউ বলেন বাঞ্চানগর ও সমসেরাবাদ মৌজার পশ্চিমে ‘লক্ষ্মীপুর’ নামে একটি মৌজা ছিল। কোন ইতিহাসবেত্তার মতে সপ্তদশ শতাব্দীতে লক্ষ্মীদহ পরগনা থেকে লক্ষ্মীপুর নামকরণ করা হয়েছে। আবার শ্রুতি আছে দালাল বাজারের জমিদার রাজা গৌর কিশোর রায় চৌধুরীর বংশের প্রথম পুরুষের নাম লক্ষ্মী নারায়ণ রায় (বৈষ্ণব) এবং রাজা গৌর কিশোরের স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী প্রিয়া। ধারণা করা হয়, এদের কারোর নাম অনুসারে লক্ষ্মীপুর নামকরণ করা হয়েছে। লক্ষ্মীপুর নামকরণ দালাল বাজারের জমিদার দ্বারা হয়েছিল একথা অধিক প্রতিষ্ঠিত। প্রশাসনিক ইতিহাসেও রয়েছে রূপান্তরের বিকাশ। লক্ষ্মীপুর নামে সর্বপ্রথম থানাপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬০ সালে। এরপর ১৯৭৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ৫নং বাঞ্চানগর ইউনিয়ন লক্ষ্মীপুর পৌরসভায় রূপামত্মরিত হয়। পরে এই পৌরসভাটির বিসত্মৃতি ঘটে। রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি ও লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৯ জুলাই লক্ষ্মীপুর মহকুমা এবং একই এলাকা নিয়ে ১৯৮৪ সালের ২৮ শে ফেব্রম্নয়ারী গঠিত হয় লক্ষ্মীপুর জেলা। পরবর্তীতে রামগতি উপজেলাকে ভাগ করে কমলনগর উপজেলা গঠিত হয়। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলাটি ৫৮ টি ইউনিয়ন ও ৪ টি পৌরসভার সমন্বয়ে ৫ টি উপজেলা, ৪৭৪টি মৌজা ও ৫৪৭টি গ্রাম নিয়ে সর্বমোট ১,৫৩৪.৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত। আদমশুমারী ও গৃহগণনা ২০১১ অনুযায়ী জেলার জনসংখ্যা ১৭,২৯,১৮৮। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ১২০০ জনের বাস। জনসংখ্যা বাড়ছে ১.৪৮% হারে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুর এ অঞ্চলে আবহাওয়া মৃদু উষ্ণ ও আর্দ্র, সহনশীল তাপমাত্রা (সর্বোচ্চ ৩৪.৩০ সেঃ, সর্বনিম্ন ১৪.৪০ সেঃ) ও মাঝারি আকারের বৃষ্টিপাতের কারণে ( গড়ে ৩.৩০২ মি.মি.) এ অঞ্চল চা্ষাবাদের জন্য অত্যমত্ম উপযোগী, তাই কৃষিজীবী বা কৃষিভিত্তিক শ্রমজীবীর সংখ্যাই এখানে সর্বাধিক (৭৩%)। প্রধানতঃ এ অঞ্চলে ধানের আবাদ সবচেয়ে বেশি হলেও সয়াবিন বর্তমানে এ অঞ্চলের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ফসল। মোট দেশজ সয়াবিন উৎপাদনের সিংহভাগ-ই উৎপন্ন হয় লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চলের লবণাক্ত বেলে-দোআঁশ মাটিতে । জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত সাম্প্রতিক সার্বিক সয়াবিন উৎপাদনের তথ্য বিশেস্নষণ করলে দেখা যায় ২০১০-২০১১ সালে মোট ৩৯,২৮৭ হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয় এবং মোট উৎপাদন হয় ৭৭১০৫ মেট্রিক টন। সয়াবিনের আছে বহুবিধ ব্যবহার। সয়াবিন থেকে সয়াডাল, সয়াদুধ, সয়াছানা, সয়াপিয়াজু, হালুয়াসহ নানাবিধ পুষ্টিকর খাবার তৈরি করা যায়। পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবেও এটি জনপ্রিয়। এছাড়া সুপারি ও নারিকেল গাছের সারির সমারহ জেলাকে দিয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্য। লক্ষ্মীপুরের জনগণের প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের একটি হলো মাছ ধরা। লক্ষ্মীপুরে মেঘনার রূপালি ইলিশ মেটায় দেশের চাহিদার একটি বড় অংশ। এই জেলায় রয়েছে লোনা ও মিঠা পানির মাছের সমারহ। এছাড়া চিংড়ি, মৌরালা, পুঁটি, খোলসে, বাইন ও চেলা মাছের প্রাচুর্য ও মিঠা পানির মাছ যেমন: রুই, মৃগেল, আইর, টেংরা, মাগুর, সিং, কই, পাবদা প্রভৃতি মাছের সমারহ লক্ষ্মীপুরকে আলাদা ভাবে পরিচিত করায়। লক্ষ্মীপুর জেলাটি হিন্দু-মুসলমান মিলিত জীবন যাপনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। উভয় ধর্মধারায় এ অঞ্চলের সংস্কৃতি সমৃদ্ধি লাভ করেছে। এর প্রমাণ মেলে এ জেলার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে। এ জেলায় দর্শনীয় যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে আছে মসজিদ, মন্দির, জমিদার বাড়ি, মঠ ইত্যাদি। যার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলোঃ হযরত সৈয়দ শাহ মিরান (রঃ) এর মাজার, দালাল বাজার জমিদার বাড়ী, খোয়াসাগর দিঘী, কামানখোলা জমিদার বাড়ি, রায়পুর চুন্নু মিয়া জমিদার বাড়ী, করপাড়া জমিদার বাড়ী, তিতাখাঁ মসজিদ, মান্দারী জামে মসজিদ, মটকা মসজিদ, শ্যামপুর দায়রা শরীফ ইত্যাদি। এর মধ্যে হযরত সৈয়দ শাহ্ মিরান (রঃ) এর মাজার বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। দিগন্তজোড়া ধানক্ষেত, উত্তাল মেঘনার রূপালি রূপ ও সারি সারি নারিকেল ও সুপারির বন, সুপ্রাচীন ঐতিহ্যময় ধর্মীয় উপাসনালয় ও জমিদার বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলাকে দিয়েছে অনন্য সৌন্দর্য। |
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস